শেরপুরে ছাত্র-আন্দোলনে ৩ হত্যাকাণ্ড: চার্জশিটে সাবেক এমপি-ম্যাজিস্ট্রেটসহ ৫০৫ জন; বিচার নিয়ে উদ্বিগ্ন সচেতন সমাজ

স্টাফ রিপোর্টার
বৃহস্পতি, 10.07.2025 - 12:14 AM
Share icon
Image

মারুফুর রহমান, শেরপুর॥ ২০২৪ সালের ৪ আগস্ট। বৈষম্যবিরোধী দাবিতে উত্তাল হয়ে উঠেছিল শেরপুর শহর। শিক্ষার্থীদের সেই গণ-আন্দোলন রূপ নেয় এক দফার সরকারবিরোধী বিক্ষোভে। কিন্তু সেই দিনেই শহরের খরমপুর এলাকায় রক্তাক্ত অধ্যায়ের সূচনা। গুলিতে ও গাড়িচাপায় প্রাণ হারান তিন তরতাজা কলেজছাত্র, সবুজ মিয়া, মাহবুব আলম ও শারদুল আশীষ সৌরভ।

প্রায় এক বছর পর, তিনটি হত্যা মামলায় শেরপুরের রাজনীতির শীর্ষ নেতাদের বিরুদ্ধে চার্জশিট আদালতে জমা দিয়েছে পুলিশ। চার্জশিটে রয়েছেন সাবেক হুইপ ও সংসদ সদস্য আতিউর রহমান আতিক,  জেলা ও উপজেলা পরিষদ চেয়ারম্যান হুমায়ুন কবির রুমান, সাবেক মেয়র গোলাম মোহাম্মদ কিবরিয়া লিটন, নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট, সরকারি চালকসহ ৫০৫ জন। 

এছাড়াও আরও উল্লেখযোগ্য আসামিদের মধ্যে রয়েছেন শেরপুর-৩ আসনের সাবেক সংসদ সদস্য এডিএম শহিদুল ইসলাম, সংরক্ষিত আসনের সাবেক সংসদ সদস্য অ্যাডভোকেট ফাতেমাতুজ্জহুরা শ্যামলী,  মো: আবু বকর বাক্কার (নালিতাবাড়ী), হাফিজুর রহমান লিটন (নকলা) ও মোহম্মদ আলী লাল (শ্রীবরদী), সাবেক উপজেলা চেয়ারম্যান রফিকুল ইসলাম, আব্দুল্লাহেল ওয়ারেজ নাঈম (ঝিনাইগাতি), মাহবুব আলম সোহাগ (নকলা), জুয়েল আকন্দ (শ্রীবরদী), হাজী মো: মোশারফ হোসেন ও মোকসেদুর রহমান লেবু (নালিতাবাড়ী) ।

এছাড়া এই মামলায় আওয়ামী লীগ ও সহযোগী সংগঠনের নেতাকর্মীদের পাশাপাশি আরও আসামী হয়েছেন জেলা জাসদের সভাপতি মনিরুল ইসলাম লিটন। 

অন্যদিকে চার্জশিটে থাকা আসামিদের মধ্যে জেলা আওয়ামী লীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক এডভোকেট চন্দন কুুমার পালসহ কয়েকজন কারাগারে থাকলেও মূল আসামিদের প্রায় সবাই এখনও ধরাছোঁয়ার বাইরে রয়েছেন।

এদিকে পুলিশের প্রাথমিক তদন্তে সত্যতা না পাওয়ায় অব্যাহতির আবেদন জানানো হয়েছে, পুলিশের ডিআইজি ও শেরপুরের সাবেক এসপি আনিসুর রহমান, সদর উপজেলার চরমোচারিয়া ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান ও যুবলীগ নেতা সাব্বির আহমেদ খোকন, শহর আওয়ামী লীগ নেতা জুলফিকার আলী ও সাংবাদিক মেরাজ উদ্দিনসহ ৩৩ জনের নাম।

 ৯ জুলাই বুধবার দুপুরে ওই ৩ চাঞ্চল্যকর হত্যা মামলার চার্জশিট দাখিলের বিষয়টি নিশ্চিত করে কোর্ট পুলিশ পরিদর্শক মো. জিয়াউর রহমান জানান, ওইসব মামলায় আদালতে চার্জশিট গৃহিত হলেই পলাতক আসামিদের বিরুদ্ধে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি হবে।

নির্মম সেই দিন: ছাত্রদের মৃত্যু, ন্যায়বিচারের শুরু

জানা গেছে, নিহত সবুজ মিয়া গুলিবিদ্ধ হয়ে মারা যান আওয়ামী লীগের একাংশের পাল্টা মিছিলে গুলিবর্ষণের সময়। আর বাকি দুইজন ছাত্র নিহত হন প্রশাসনের নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটকে বহনকারী দ্রুতগামী গাড়ির নিচে পড়ে। 

নিহত সবুজের ভাই সাদ্দাম হোসেন বলেন,

“আমার ভাই তো কোনো অপরাধ করেনি, শুধু মিছিলে ছিল। গুলি করা হলো কেন? আমরা ন্যায়বিচার চাই, শুধু প্রতিশ্রুতি না।”

ঘটনার পরপরই দায়ের হয় পৃথক তিনটি মামলা। এর মধ্যে সবুজ মিয়ার পরিবারের দায়ের করা মামলায় প্রথমে ২৫ জনকে আসামি করা হলেও তদন্তে ধাপে ধাপে তা বেড়ে ২০৫ জনে দাঁড়ায়। অপর দুই মামলায় বাকি আসামিদের বিরুদ্ধে চার্জশিট দেওয়া হয়।

কারা কারা আছেন চার্জশিটে?

চার্জশিটে রয়েছেন শেরপুর জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি ও সাবেক হুইপ আতিউর রহমান আতিক, সাধারণ সম্পাদক ও সাবেক এমপি ছানুয়ার হোসেন ছানু, জেলা পরিষদ চেয়ারম্যান হুমায়ুন কবীর রুমান, সাবেক এমপি এডিএম শহিদুল ইসলাম, সংরক্ষিত আসনের সাবেক এমপি ফাতেমাতুজ্জহুরা শ্যামলী, মেয়র ও সহ স্থানীয় সরকারের প্রথম সারির ২৫ জন জনপ্রতিনিধি।

প্রসঙ্গত, শেরপুর জাসদের সভাপতি মনিরুল ইসলাম লিটন'ও রয়েছেন চার্জশিটে।

প্রশাসনের ভূমিকা নিয়েও প্রশ্ন: ‘গাড়িচাপা’ ছিল দুর্ঘটনা না পরিকল্পিত?

ঘটনার সময় একটি ম্যাজিস্ট্রেটের গাড়ি ‘বেপরোয়া গতিতে’ ছাত্রদের ওপর উঠিয়ে দেওয়ার অভিযোগ ওঠে। তবে প্রশাসনের পক্ষ থেকে তখন তা ‘দুর্ঘটনা’ বলে দাবি করা হয়েছিল। কিন্তু নিহতদের স্বজন ও প্রত্যক্ষদর্শীদের বক্তব্য ভিন্ন। 

সচেতন মহলের দাবি, “সরকারি যানবাহনের এমন ‘প্রাণঘাতী’ ব্যবহার পরিকল্পিত না হলে সেটা তদন্তে উঠে আসত। ম্যাজিস্ট্রেটের নাম চার্জশিটে থাকা তাৎপর্যপূর্ণ।”

কারা পেলেন অব্যাহতি?

প্রাথমিক তদন্তে অপরাধ প্রমাণিত না হওয়ায় পুলিশের ডিআইজি, শেরপুরের সাবেক এসপি আনিসুর রহমান, একজন ইউপি চেয়ারম্যান, এক সাংবাদিকসহ মোট ৩৩ জনকে চার্জশিট থেকে বাদ দেওয়ার সুপারিশ করা হয়েছে।

বিচারপ্রক্রিয়ার গতি নিয়ে উদ্বেগ: ‘প্রভাবশালী বলেই ধরা যাচ্ছে না?’

চার্জশিটে নাম থাকলেও অধিকাংশ প্রভাবশালী আসামি এখনও গ্রেফতার হয়নি। পলাতকদের বিরুদ্ধে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারির পূর্বশর্ত হচ্ছে আদালতের চার্জশিট গ্রহণ। 

শেরপুর জেলা আইনজীবী সমিতির এক সিনিয়র সদস্য বলেন, “কাজটা এখন আইনের। তবে প্রশ্ন হচ্ছে, বিচার কি আইনের পথে চলবে? নাকি প্রভাবশালীদের ছায়ায় চাপা পড়বে?”

রাজনৈতিক বিশ্লেষণ: এই চার্জশিট শাসক দলের ভিত নাড়িয়ে দিতে পারে?

রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মতে, এই চার্জশিট শুধু একটি মামলার অগ্রগতি নয়, এটি বর্তমান শেরপুর জেলার রাজনৈতিক পরিবেশে বড় ধরনের ধাক্কা। ক্ষমতাসীন দলের ভেতরে চাপা উত্তেজনা বিরাজ করছে। স্থানীয় পর্যবেক্ষক ও এক সাবেক শিক্ষক বলেন, “এই ঘটনা সরকারের একটি পর্যালোচনার বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। তৃণমূলের দমন-পীড়ন ঢাকতে গেলে একদিন পুরো দলকে দায় নিতে হয়।”

নিহত ছাত্রদের পরিবারের প্রতিক্রিয়া: ‘বিচার পেতে কতোটা পথ পেরোতে হবে?’

চার্জশিট দাখিলের খবরে নিহত তিন ছাত্রের পরিবারে দেখা দিয়েছে মিশ্র প্রতিক্রিয়া, একদিকে স্বস্তি, অন্যদিকে আশঙ্কা। তারা বলছেন, "প্রথম ধাপে চার্জশিট দাখিল হলেও আমরা এখনো নিশ্চিত না, আদৌ ন্যায়বিচার হবে কিনা।"

সবুজ মিয়ার মা রওশন আরা কান্নাভেজা কণ্ঠে বলেন, “আমার ছেলেটা কি রাজনীতি করতো? শুধু একটা মিছিলে গিয়েছিল, তাতেই গুলি করে মেরে ফেললো! এখন চার্জশিট দিয়েছে শুনলাম, কিন্তু বিচার কি সত্যিই হবে?” তিনি বলেন, "আমরা অনেক কিছুই বুঝি না, শুধু চাই আমার ছেলের হত্যাকারীরা যেন শাস্তি পায়।"

মাহবুব আলমের বাবা সেকান্দার আলী বলেন, “প্রশাসনের গাড়ি ওদের পিষে দিয়ে চলে গেছে। কেউ একটিবার ফিরে তাকায়নি। এতদিনে একটা চার্জশিট হলো, কিন্তু যারা দায়ী তারা তো এখনও বাইরে। আইন কি শুধু প্রভাবশালীদের জন্য?”

শারদুল আশীষ সৌরভের বড় ভাই বিপ্লব রায় ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, “শুধু কাগজে নাম আসলে হবে না, গ্রেফতার, বিচার আর সাজা, এই তিনটা আমরা চাই। এই মৃত্যুগুলো যেন রাজনৈতিক সমঝোতার আগুনে পুড়ে না যায়।”

পরিবারগুলোর সকলেই আশঙ্কা করছেন, প্রভাবশালী আসামিদের কারণে বিচার প্রক্রিয়া বিলম্বিত বা প্রভাবিত হতে পারে। তারা প্রধান উপদেষ্টার সরাসরি হস্তক্ষেপ চেয়েছেন, যেন এই বিচার হয় ‘নিরপেক্ষ ও দ্রুত’।

Share icon